ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই আরব বণিকগণ ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতাে। আরবে দ্বীন ইসলাম এসে পুরো আরবজাতিকে আলোকিত করার পরও এই ধারা অব্যাহত থাকে। আরব মুসলিম নাবিকদের অনেকেই উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। স্থানীয় যেসব নারী ইসলামের মহত্বে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতো তাদেরকে বিবাহ করেন তারা। এভাবে কালক্রমে তারা বেশ কয়েকটি উপনিবেশ গড়ে তােলে। কিন্তু দ্বীন ইসলাম আসার প্রায় একশ বছর পর ভারতে মুসলমান শাসনের গােড়াপত্তন হয়।

উমাইয়া খিলাফতের খলীফা প্রথম ওয়ালিদ তখন ক্ষমতায়। তার অধীনে পূর্বাঞ্চলের (ইরাক) গভর্নর ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশে মুসলমানগণ ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উর-পশ্চিমাঞ্চলে অভিযান চালায়। তারা সিন্ধু ও মুলতান বিজয় করে। এই ঘটনার প্রায় তিনশ’ বছর পর গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযান করেন। এটি ছিল মুসলিম অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায়। এই পর্যায়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব মুসলমান অধিকারে আসে। মাহমুদের অভিযানের প্রায় পৌনে দু’শ বছর পর ঘুরি থেকে তৃতীয় ও চড়ান্ত পর্যায়ের অভিযান চালানাে হয়। শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরি ছিলেন এই অভিযানের নায়ক। ঘুরির লােক ছিলেন বলে ভারতের ইতিহাসে তিনি মুহম্মদ ঘােরী নামে পরিচিত। তিনি দিল্লী ও এর আশেপাশের এলাকা বিজয় করেন। ফলে ভারতে স্থায়ীভাবে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ।

সিন্ধু অভিযানের কারণঃ
অনেক ঐতিহাসিক তখন ভারতবর্ষের ধন-সম্পদের লোভে মুসলিমরা অভিযান চালিয়েছে এমন ভ্রান্ত ইতিহাস প্রচার করে থাকে। তৎকালী সময়ে রাজা দাহির ছিলো সিন্ধু ও মুলতানের রাজা। আর উমাইয়া খিলাফতের খলীফা ছিলেন প্রথম ওয়ালিদ। তখন উমাইয়া খিলাফতের পুর্বাঞ্চল তথা ইরাকের গভর্ণর ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সিন্ধু, মুলতান ও উমাইয়া খিলাফতের মধ্যে তখন সীমান্ত ছিলো। সেসময় রাজা দাহির আরব অঞ্চলে যেসব লুটেরা দস্যু এবং অপরাধী ছিলো তাদের আশ্রয় দিতো এবং বিশেষ করে আরব বণিকদের ব্যবসা বাণিজ্যে বাধার সৃষ্টি করতো। বিশেষ করে ভারতে প্রথম মুসলিম অভিযান চালানো হয় মুলত মুসলিম নির্যাতনের কারণেই। সেইসময় বেশ কয়েকজন আরব বণিক শ্রীলংকায় ইন্তেকাল করেন। শ্রীলংকার রাজা তাদের মরদেহ, তাদের পরিবারপরিজন ও অর্থসামগ্রী আটটি জাহাজে বােঝাই করে উমাইয়া খিলাফতের রাজধানী দামেস্কের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। সাথে খলিফা এবং হাজ্জাজের জন্য কিছু উপহারও ছিল। সিন্ধুর বন্দর দাইরুলের (বর্তমান করাচির সন্নিকটে) কাছে এ সকল জাহাজ রাজা দাহিরের নির্দেশে লুষ্ঠিত হয় এবং জাহাজে থাকা মুসলিম নারীদের কারাবন্দী করা হয়। পরবর্তীতে কারাগারে বন্দি থাকা এক মুসলিম নারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে রক্তে লেখা চিঠি পাঠায় এবং মুসলিম উম্মাহর একজন নারী হিসেবে উদ্ধারের জন্য আকুতি জানায়। সেই মুসলিম নারী চিঠিতে লেখেন –
‘“দূতের মুখে মুসলমান শিশু ও নারীদের বিপদের কথা শুনে আমার দৃঢ় বিশ্বাস বসরার শাসনকর্তা স্বীয় সৈন্য বাহিনীর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সৈনিককে অশ্ব প্রস্তুত করার আদেশ দিয়েছেন। সংবাদ বাহককে আমার এ পত্র দেখাবার প্রয়োজন হবে না। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের রক্ত যদি শীতল হয়ে জমে গিয়ে থাকে তবে হয়ত আমার এ পত্রও বিফল হবে। আমি আবুল হাসানের কন্যা। আমি ও আমার ভাই এখনো শত্রুর নাগালের বাইরে। কিন্তু আমার অন্য সকল সঙ্গী শত্রু হাতে বন্দী – যার বিন্দু মাত্র দয়া নাই। (শত্রু বলতে মূলত অত্যাচারী রাজা দাহিরকেই বোঝানো হয়েছে) বন্দীশালার সেই অন্ধকার কুঠুরির কথা কল্পনা করুন – যেখানে বন্দীরা মুসলিম মুজাহিদদের অশ্বের ক্ষুরের শব্দ শুনার জন্য উৎকর্ণ ও অস্থির হয়ে আছে। আমাদের জন্য অহরহ সন্ধান চলছে। সম্ভবতঃ অচিরেই আমাদেরকেও কোন অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী করা হবে। এও সম্ভব যে, তার পূর্বেই আবার যখন আমাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়া হবে এবং আমি সেই দুরদৃষ্ট হতে বেঁচে যাব। কিন্তু মরবার সময় আমার দুঃখ থেকে যাবে যে, যেসব ঝাঞ্চাগতি অশ্ব তুর্কিস্তান ও আফ্রিকার দরজা ঘা মেরেছে, স্বজাতির এতীম ও অসহায় শিশুদের সাহায্যের জন্য তারা পৌছাতে পারল না। এও কি সম্ভব যে তলোয়ার রোম ও পারস্যের গর্বিত নরপতিদের মস্তকে বজ্ররূপে আপতিত হয়েছিল, সিন্ধুর উদ্ধত রাজার সামনে তা ভোঁতা প্রমাণিত হল। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। কিন্তু হাজ্জাজ, তুমি যদি বেঁচে থাক, তবে আমার আত্মমর্যাদাশীল জাতির এতীম ও বিধবাদের সাহায্যে ছুটে এস।’
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পুরো চিঠি পড়তে পারলেন না। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ চিঠির অর্ধেকটা পড়েই আরও ক্রোধান্নিত হয়ে জুবায়র ও মুহম্মদ বিন কাশিমকে দামেস্কে খলীফার কাছে পাঠান, এই বলে যে তারা যেন যেভাবেই হোক খলীফাকে রাজা জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। পরবর্তীতে খলীফার কাছ থেকে রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে অভিযানের অনুমতি মিললে তিনি ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইল নামক দুই প্রসিদ্ধ কমান্ডারের নেতৃত্বে সিন্ধুতে পরপর দুটি অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিখ্যাত ইসলামী সিপাহসালার তরুন যুবক মুহম্মদ বিন কাশি (রহঃ) কে সিন্ধু বিজয়ে প্রেরণ করেন এবং তা সফল হয়। (পরবর্তী পর্বে মুহম্মদ বিন কাশিম এবং সিন্ধু অভিযানের সকল ঘটনা বর্ননা করা হবে ইনশাআল্লাহ!)
সুত্র:
উইকিপিডিয়া
ইন্টারনেট