উসমানীয় সালতানাত যখন সাফল্যের চরম শিখরে, উসমানীয় সৈনিকদের ঘোড়ার খুরের আঘাত যখন একের পর এক ক্রসেডারদের এলাকা থরথর করে কেঁপে উঠছে ঠিক সেই সময় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পারস্যের বুকে উদ্ভব ঘটে সাফাভিদ শিয়া রাজবংশের। সাফাভিদ শিয়া রাজবংশের সূচনার পর থেকেই উসমানীয়দের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব, যা স্থায়ী হয়েছিল সাফাভিদ শিয়াদের উত্তরসূরি আফশারি রাজবংশ পর্যন্ত। ১৫১৪ সাল থেকে ১৭৪৭ সাল পর্যন্ত তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী উসমানীয় সালতানাতের সাথে সাফাভিদ শিয়া সাম্রাজ্যের মধ্যে একাধিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে।

উসমানীয়দের সাথে সাফাভিদদের দ্বন্দ্বের মূল কারণই ছিলো ধর্মীয়। কারণ সেসময় সাফাভিদ শিয়ারা ইসলামের নাম দিয়ে এমন কিছু ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিচালনা করতো যা ইসলামী শরীয়তসম্মত ছিলোনা। সেইসাথে খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধেও বাধার সৃষ্টি করেছিলো এই সাফাভিদ রাজবংশ। সাফাভিরা ছিলো শিয়া। এই সাফাভিদদের হাত ধরেই ইরানে শিয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
উসমানীয়-শিয়া সাফাভিদ যুদ্ধের ১৬২৩ থেকে ১৬৩৯ সালের পর্যায়কালের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ১৬৩৮ এর বাগদাদের যুদ্ধ বা বাগদাদ অবরোধ। এ যুদ্ধে সাফাভিদদের পক্ষে ছিলো বেকতাশ খান গর্জি আর উসমানীয়দের নেতৃত্ব ছিলো উসমানীয় সালতানাতের বিচক্ষন ও যোদ্ধা সুলতান চতুর্থ মুরাদের হাতে। তৎকালীন প্রতক্ষদর্শীদের মতে, যুদ্ধে উসমানীয়দের ছিলো এক লক্ষেরও বেশি সৈন্য। যাদের মধ্যে ৩৫ হাজার ছিলো উসমানীয় সুলতানদের রক্ষায় নিয়োজিত বিশেষ পদাতিক বাহিনী জেনিসারী আর প্রায় ৭৫ হাজার ছিলো অশ্বারোহী বাহিনী।

এছাড়া উসমানীয়দের ছিলো ২০০ কামান যেখানে সাফাভিদদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ১০০। তৎকালীন বাগদাদ ছিলো সাফাভিদ শিয়াদের দখলে। তাই যুদ্ধের জন্য অশ্বারোহী বাহিনীর খুব একটা প্রয়োজন পড়েনি তাদের। তাদের সম্বল ছিলো ৪০ হাজার পদাতিক সৈন্য আর বাগদাদের চতুর্দিক ঘিরে ২১১ সুরক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত টাওয়ার।

ইস্তানবুল থেকে বাগদাদের দূরত্ব ১৬০০ কিলোমিটার। উসমানীয় সেনাবাহিনী এই দূরত্ব ১৯৭ দিনে পাড়ি দেয়। এরপরই তারা চারিদিক থেকে বাগদাদ ঘিরে ফেলে। আনুষ্ঠানিক ভাবে অবরোধের শুরু ১৫ই নভেম্বর। বাগদাদ শহরটি চারিদিক থেকে উঁচু উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিলো। উসমানীয়দের আক্রমন ঠেকাতে সাফাভিদরা তাদের সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে শহরের প্রধাণ ৪ টি গেটে মোতায়ন করে। উসমানীয়দের গ্র্যান্ড ভিজিয়ার তৈয়ার মেহমেত পাশার বিচক্ষণতায় সবচেয়ে দূর্বল গেটে আঘাত হানে উসমানীয়রা। এতে করে উসমানীয়দের পক্ষে শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা সম্ভব হয় এবং সাফাভিদ সৈন্যদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। শহরে প্রবেশের পূর্বে এই অবরোধ ৪০ দিন স্থায়ী হয়। যুদ্ধের শেষ দিকে সুলতান মুরাদ তার গ্র্যান্ড ভিজিয়ারকে সর্বাত্মক আক্রমনের নির্দেশ দিলে সর্বশেষ ২৫শে ডিসেম্বর, ১৬৩৮ এ বাগদাদ পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তবে শেষ পর্যায়ের এই আক্রমনে গ্র্যান্ড ভিজিয়ার মেহমেত পাশা শাহাদাতবরণ করেন।

যুদ্ধের পর সুলতানের নতুন গ্র্যান্ড ভিজিয়ার কামানকাশ মুস্তফা পাশা এবং পারস্যের প্রতিনিধি সারুহান এক শান্তিচুক্তি আলোচনা শুরু করে। ১৭ই মে, ১৬৩৮ এ সাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক যুহাবের চুক্তি বা Treaty of Zuhab। আজকের দিনের আধুনিক ইরান-তুরস্ক ও ইরাক-ইরান এর মধ্যকার সীমানা নির্ধারণ অনেকটা এই চুক্তির মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছিলো বলা যায়।
বাগদাদ অভিযানের সময় সুলতান মুরাদ তার দুই গ্র্যান্ড ভিজিয়ারকে হারায়। প্রথমজন বৈরাম পাশা, তিনি বাগদাদ অভিমুখ গমনকালে স্বাভাবিকভাবে মৃতুবরণ করেন। আর দ্বিতীয় জন মেহমেত তৈয়ার, যিনি যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মৃত্যমুখে পতিত হন। উসমানীয়দের ইতিহাসে মেহমেত তৈয়ার হন ৩য় ভিজিয়ার যিনি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন।
সুত্র:
- Sultan Murad The Great
- উসমানীয় ইতিকথা (আল শামস)
- Islami Archive (2002)