আফ্রিকা মহাদেশে বেশ কয়েকটি মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। যেগুলোর কোনোটিকে সালতানাত আবার কোনোটিকে সরাসরি খিলাফত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এসবের মধ্যে আফ্রিকার উত্তর নাইজেরিয়ায় একসময় প্রতিষ্ঠিত হওয়া সোকোটো খিলাফত অন্যতম। আফ্রিকার অন্যান্য মুসলিম সালতানাতগুলো নিয়ে ইতিহাসে আলোচনা হলেও সোকোটো খিলাফত নিয়ে তেমন আলোচনা করেনা আফ্রিকান ঐতিহাসিকরা।

১৮০৪ সালে উত্তর নাইজেরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া সোকোটো খিলাফত ছিলো আফ্রিকার বৃহত্তর সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি। ‘ফুলানি জিহাদ বা পবিত্র যুদ্ধ’ নামক একটি সামরিক অভিযানের মধ্যে দিয়ে এই খিলাফত গড়ে উঠেছিলো। এই খিলাফত ১৯০৩ সালের শেষের দিক পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। পরবর্তীতে ফরাসি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে পতন হয় এই মুসলিম শাসনের।
সোকোটো খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় উসমান ড্যান ফোডিও নামের এক বুজুর্গ ব্যক্তিকে। তিনি ১৭৭০ সালে তিনি তার নিজের জন্মভূমি গোবিরে দ্বীন ইসলামের প্রচার শুরু করেন। গোবির বর্তমানে নাইজেরিয়ার একটি প্রদেশ। তিনি এই অঞ্চলের মুসলমানদেরকে পূর্বের ছেড়ে আসা বিধর্মী সকল কৃষ্টি সংস্কৃতি পরিত্যাগ করা এবং দ্বীন ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। সে সময় আফ্রিকার বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে একটি ছিলো ফুলানি সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষরা দ্বীন ইসলাম চর্চা করতো এবং এরা পশ্চিম আফ্রিকার বৃহৎ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। এখনও আফ্রিকায় এই জনগোষ্ঠীটি রয়েছে। তৎকালীন সময়ে এই ফুলানিদের মধ্যে অনেক বড় সুফী আলেম, ইসলামি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যারা মানুষকে সঠিক ইসলাম চর্চার পাশাপাশি জিহাদের জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। উসমান ফোডিও ফুলানি পন্ডিতদেরই একজন ছিলেন।

তিনি যে শহরে জন্মগ্রহণ করেন তথা গোবির রাজ্যটি তৎকালীন হাউসা সালতানাতের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। হাউসাও সালতানাত সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিলো। উসমান ফোডিওর সময় এই রাজ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানকার জনগণ হাউসা শাসক ও গভর্নরদের অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ট ছিলো। রাজ্যব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো বিশৃঙ্খলা। তখন উসমান ড্যান ফোডিও এই রাজ্যের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিলেন। যা ইতিহাসে ‘ফুলানী ওয়ার বা ফুলানী যুদ্ধ কিংবা ফুলানী জিহাদ নামে পরিচিত।

গোবির রাজ্যে উসমান ফোডিওর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকায় এবং হাউসা শাসকদের দুর্নীতি-অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় তাকে বিপদজ্জনক মনে করে গোবির শাসন করা হাউসা শাসক তাকে গোবির থেকে বিতাড়িত করে। ফলে উসমান ফোডিং নবীজী (সাঃ) এর হিজরতের সুন্নত হিসেবে নিজ মাতৃভূমি থেকে অন্যত্র চলে যান নির্যাতনের শিকার হয়ে। এরপর তিনি ১৮০৪ সালের দিকে ফুলানী মুসলিম এবং শক্তিশালী যুবকদের নিয়ে হাউসা সালতানাতের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জিহাদ অবতীর্ণ হন। টালমাটাল হাউসা সাম্রাজ্য এই জিহাদে টিকতে না পেরে তাদের পতন হয়। উসমান ফোডিও হাউসা শাসনের পতন ঘটিয়ে গোবিরসহ হাউসার অধীনে থাকা সকল রাজ্যগুলোকে নিয়ে ১৮০৪ সালের শেষের দিকে সোকোটো খিলাফত গঠনের ঘোষণা দেন। তবে খিলাফতের ঘোষণা দিলেও তারা কখনো নিজেদের খলীফা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন না। সবাই সুলতান উপাধিই গ্রহণ করেছিলেন।
সোকোটো খিলাফত গঠনের পর ইন্তেকাল করেন উসমান। পরবতীতে দ্বিতীয় সুলতান হিসেবে পুত্র মুহম্মদ বেলো সুলতান উপাধি গ্রহণ করে খিলাফতের মসনদে বসে। তার সময়কাল সোকোটা শাসনের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। তিনি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সোকোটো খিলাফতের সীমানা বৃদ্ধি করেন এবং ন্যায়বিচারের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তিনি শক্তিশালী রাজ্য পরিচালনা কাঠামো তৈরী করেন। সোকোটোর শাসনামলে সোকোটো সাম্রাজ্যে থাকা অমুসলিমরাও সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। তবে এর পরিবর্তে তাদেরকে জিজিয়া প্রদান করতে হতো। এতে করে পুর্বের হাউসা জনগণ নতুন এই মুসলিম শাসনব্যবস্থাকে আপন করে নিয়েছিলো। জনগন খুশি থাকায় সোকোটো খিলাফত স্থিতিশীল হয় এবং দেশ-দেশান্তর থেকে বাণিজ্য কাফেলা এই সাম্রাজ্যে আসতে থাকে। ফলে খিলাফতের অর্থনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী হয়।

সোকোটো খিলাফতের অন্যতম অবদান হলো শরীয়াভিত্তিক নারীদের অধিকার। মুহম্মদ বেলো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইসলাম নারীদের পূর্ণ অধিকার প্রদান করেছে। তবে সেটা হতে হবে শরীয়তভিত্তিক। বেহায়াপনার মাধ্যমে কখনো নারীদের অধিকার আদায় হয় না। তিনি নারীদের জন্য মাদ্রাসা ও উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি নবীজীর আদর্শ অনুযায়ী নারীদের পূর্ণ সম্মান প্রদর্শনের জন্য আলাদা আইনও প্রণয়ন করেছিলেন।
১৯০১ সালের পর থেকে যোগ্য শাসকের অভাবে ধীরে ধীরে ক্ষমতা হারাতে থাকে সোকোটো খিলাফত। সোকোটোর অধীনে থাকা রাজ্যগুলোর শাসনকর্তারা খিলাফত থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে শাসন করতে থাকে। আর এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে ১৯০৩ সালে নাইজেরিয়ার এই ভূখন্ড দখল করে নেয় ফরাসি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। পতন হয় সোকোটো খিলাফতের। সীমিত সময়ের জন্য হলেও সোকোটো খিলাফত ইসলামী স্বর্ণালী ইতিহাসেরই একটি অংশ।
তথ্য-উপাত্তের অভাবে এই শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আর বেশি কিছু লিখা গেলো না। সাল নিয়েও ত্রুটি থাকতে পারে। এজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
সুত্র:
blackpast.org
https://iracing.fandom.com/
https://en.wikipedia.org/