দ্বীন ইসলামের শুরুর যুগ থেকেই লিবিয়া একটি মুসলিম ভূখন্ড হিসেবে পুরো বিশ্বে পরিচিত। সে সময় এই ভূখন্ড সিসিলিয়ান নরম্যান শাসনের অধীনে ছিলো। পরবর্তীতে ১২ শতকের দিকে উত্তর আফ্রিকায় বারবার মুসলিমরা আলমোহাদ খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করে। যা ইবেরিয়ান উপদ্বীপসহ উত্তর আফ্রিকার অনেক অঞ্চল শাসন করতো। লিবিয়াও এই আলমোহাদ খিলাফতের অধীনেই ছিলো। এরপর তিউনিসিয়ার হাফসিদ রাজবংশ আলমোহাদদের থেকে এটি দখল করে নেয়।

১৪৯২ সালে স্পেনের শেষ মুসলিম রাষ্ট্র আল আন্দালুস দখল করার পর স্পেনীয় ক্রুসেডাররা উত্তর আফ্রিকা আক্রমন করতে শুরু করে। স্প্যানিসরা ১৫০৫ সালে আলজেরিয়ার ওরান প্রদেশের মার্স আল কাবির নামক নৌ বন্দর, ১৫০৯ সালে পুরো ওরান প্রদেশ এবং ১৫১০ সালে আলজেরিয়ার বিকায়ে দখল করে। সে সময় তিউনিসিয়ার হাফসিদ রাজবংশের সুলতান সিংহাসন হারানোর ভয়ে স্পেনীয়দের অধীনতা স্বীকার করেছিলো। ডন পেড্রো নাভারো কমান্ডের অধীনে কাউন্ট অব অলিভেটো আলজেরিয়ার বিকায়ে দখলের পর লিবিয়ার ত্রিপোলী দখল করে। ১৫১০ সালের জুন মাসে ত্রিপোলীর মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালায় স্প্যানিস ক্রুসেডাররা। তারা ৫ হাজার মুসলমানকে শহীদ এবং হাজার হাজার নর-নারীকে বন্দি করে। ত্রিপোলী দখলের পর ইউরোপীয়রা ক্রুসেডাররা ব্যাপক উচ্ছাসে ফেটে পড়ে। তারা ত্রিপোলীর শাসন সিসিলির খ্রিষ্টান রাজ্যের কাছে সমর্পন করে। ফলে বহু খ্রিষ্টান সেটেলার ত্রিপোলীতে এসে বসবাস শুরু করে।

স্পেনীয়দের দ্বারা ত্রিপোলী দখলের পর ত্রিপোলীর মুসলমানরা ত্রিপোলী থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দুরে তাজুরা দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। এরই মধ্যে ত্রিপোলীর মুসলমানদের একটি দল ১৫১৯ সালে একটি জাহাজে করে গোপনে ইস্তাম্বুলে আসে এবং তৎকালিন উসমানীয় সিংহাসনে থাকা সুলতান সুলেমান আল কানুনীর কাছে সাহায্য চায়। কিন্তু সুলতান সুলেমানের কাছে তারা তাদের ভাষার কাছে ঠিকমতো তাদের সমস্যা বোঝাতে পারছিলো না। সে সময় হাদিম মুরাদ আগা নামের এক আগা ত্রিপোলীর ভাষা বুঝতো। পরে তার সাহায্যেই সুলতান সুলেমান বুঝতে পারেন ক্রুসেডারদের অত্যাচারের কথা। এর পরপরই সুলতান সুলেমান ৬০০০ সৈন্য এবং কিছু জাহাজ এবং সাথে হাদিম মুরাদ আগাকে পাঠান তাজুরা দুর্গে। তাজুরায় গিয়ে মুরাদ আগা সেই দুর্গ এবং তার আশেপাশে বসতি স্থাপন করেন এবং সেখান থেকেই ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। সুলতান সুলেমানের নির্দেশে তিনি সেই অঞ্চলে একটি মসজিদ এবং মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। উসমানীয়দের তৈরী সেই মসজিদ ক্রুসেডারদের আক্রমন প্রতিহত করার জন্য একটি দুর্গের ন্যায় ছিলো। সেই মসজিদ থেকে স্থানীয় মুসলমানদের পরিস্কার খাবার পানি সরবরাহ করা হতো। তিনি বহু কুপ খনন করেছিলেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় মুরাদ আগা উসমানীয় প্রশাসন এবং নৌবাহিনী প্রধান খাজা খাইরুদ্দিন বারবারোসাকে ত্রিপোলী বিজয়ের আহ্বান জানান।

খাজা খাইরুদ্দিন বারবারোসা যখন সুলতান সুলেমানের অনুরোধে উসমানীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতির পদে আসীন হন তখন উসমানীয় তার নেতৃত্বে উত্তর আফ্রিকার উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে। যার সম্ভব হয়েছিলো ‘সমুদ্র গাজীদের’ সহযোগীতায়। যেসব মুসলমানরা শুরুর দিকে নৌদস্যু ছিলো এবং খাইরুদ্দিনের সাথে ভালো সম্পর্ক তারা পরবর্তীতে দস্যুপনা ছেড়ে নিজেদের ইসলামের রাস্তায় কুরবানকারী হিসেবে প্রস্তুত করেছিলো। এজন্য তাদের সমুদ্রের গাজী বলা হতো। এরা উসমানীয়দের সেনাবাহিনীকে ছিলোনা। কিন্তু উসমানীয়দের সহযোগীতা করতো। তারা স্বাধীন ছিলো। কিন্তু খাজা খাইরুদ্দিনের ইন্তেকালের পর সমুদ্রের গাজীদের সাথে উসমানীয়দের সম্পর্কেও ছিন্ন হয়ে যায়। আর এই সম্পর্ক ছিন্নের পেছনে কাজ করেছিলো কিন্তু মুনাফিক নৌ পাশা। পরবর্তীতে তুর্কি নৌ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব তুরগুত রইস উসমানীয় নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। কিন্তু তাকে কোনো উচ্চ পদ দেয়া হয়নি। এর বহু কারণ ছিলো সে সময়।

সুলতান সুলেমান ত্রিপোলী বিজয় এবং মুসলমানদের উদ্ধারের জন্য সমর প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। কিন্তু সুলতান সুলেমান ত্রিপোলী বিজয়ের জন্য তুরগুত রঈস ব্যতিত কোনো যোগ্য ব্যক্তি পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি তুরগুত রেইসের কাছে একটি পবিত্র কুরআন এবং একটি সোনার তরবারী পাঠিয়ে তাকে ত্রিপোলী বিজয়ে নির্দেশ দেন। সেই সাথে তাকে তিউনিশিয়ার বন্দর নগরী মাহদিয়ার গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ দেন যা তখন উসমানীয়দের নিয়ন্ত্রনে ছিলো। ত্রিপোলি, বেনগাজী এবং ফেজান, যা আজ লিবিয়ার অন্তর্গত। কিন্তু অতীতে পৃথক অঞ্চল ছিল। মিশর বিজয়ের পর বেনগাজীকে উসমানীয় শাসনের অধীনে আনা হয়।
তুরগুত রেইস তখন সমুদ্রের গাজীদের কাছে চিঠি পাঠান এবং তাকে সাহায্যের অনুরোধ করেন। সমুদ্রের গাজীরাও তার ডাকে সাড়া দেয়। অবশেষে সমুদ্র গাজীদের দল এবং উসমানীয় সেনাবাহিনী তুরগুত রেইসের নেতৃত্বে প্রথমে মাল্টা দ্বীপে অবতরণ করে। এরপর তার আশেপাশের সমস্ত এলাকা, শহর বিজয় করা হয়। মাল্টার নিকটবর্তী গোজো দ্বীপটিও উসমানীয়দের নিয়ন্ত্রনে আসে। মাল্টার পর উসমানীয় নৌবহর সোজা ত্রিপোলীর দিকে রওনা হয়। খবর পেয়ে হাদিম মুরাদ আগাও তার ৬০০০ সেনা নিয়ে ত্রিপোলী অবরোধ করে। পরবর্তীতে উসমানীয় নৌবাহিনীও একইসাথে ত্রিপোলী অবরোধ করে। উসমানীয়দের কামানের আঘাতে চুর্ন বিচুর্ণ হয়ে যায় ক্রসেদারদের ঘাটি গাড়া স্থাপনাগুলো। বহু ক্রুসেডার কামানের গোলায় নিহত হয়। অবশেষে ১৫৫১ সালের ১৪ আগষ্ট স্পেনীয় ক্রুসেডাররা উসমানীয়দের কাছে আত্মসমর্পন করে। ত্রিপোলী বিজয়ের পর ফেজান থেকেও ক্রুসেডারদের হটিয়ে দেয়া হয়।

ত্রিপোলী বিজয়ের পর উসমানীয় নৌ কমান্ডার সিনান পাশা হাদিম মুরাদ আগাকে ত্রিপোলীর গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনিও হন ত্রিপোলীর প্রথম গভর্নর। তিনি ১৫৫৬ সাল তথা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যুর পর এই প্রদেশের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তুরগুত রেইসকে। তিনি ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত ত্রিপোলীর গভর্নর ছিলেন।
সুত্র:
Historian, chairman at National Defense University, Ankara